Dhaka Central Polytechnic Institute

বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষার সংকট সম্ভাবনা ও সুপারিশ

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোয় দক্ষ ও অতি দক্ষ জনসংখ্যা ৬০ শতাংশের কাছাকাছি থাকে। জার্মানিতে প্রায় ৭৩ শতাংশ জনসংখ্যা দক্ষ। জাপানে ৬৬, সিঙ্গাপুরে ৬৫, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০, চীনে ৫৫, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০, মালয়েশিয়ায় প্রায় ৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি মাধ্যমে অধ্যয়ন করেন।  বিপরীতে বাংলাদেশে সার্বিকভাবে স্বল্পদক্ষ ও দক্ষ জনশক্তি ৩৮ শতাংশ বলা হলেও কারিগরিভাবে দক্ষ, মধ্যমানে দক্ষ কিংবা স্বল্প দক্ষ জনশক্তি মাত্র ১৪ শতাংশ। 

কারিগরি শিক্ষার হার: শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ২০১৮ সালের তথ্যে দেশের কারিগরি শিক্ষার্থীদের হার মাত্র ১৪ শতাংশ। ২০২০ সালে এই হার ২০ শতাংশ এবং ২০৩০ সালে তা ৩০ শতাংশ করার লক্ষ্য নেয়া হয়েছে। তবে বাস্তবে আন্তর্জাতিক কারিগরি শিক্ষার সংজ্ঞা ও বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এটি মূলত ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘সরকারের দেয়া এই (কারিগরি শিক্ষার্থীদের) হার সঠিক নয়। কারণ কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এক নয়। বৃত্তিমূলক শিক্ষার পরের ধাপ কারিগরি শিক্ষা। সরকার কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে এক করে হিসাব করছে, এতে কারিগরির প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না।’

ব্যানবেইস’র ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬ হাজার ৮৬৫টি, যার মধ্যে সরকারি ৮৬৬টি ও বেসরকারি ৫ হাজার ৯৯৯টি। শিক্ষার্থী ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৪৮৪ জন। এতে যুক্ত করা হয়েছে ৬ মাস মেয়াদি বিভিন্ন শর্ট কোর্স। এই কোর্সের আওতাধীন ২ হাজার ৬০০ ট্রেনিং সেন্টার। আবার ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী, কারিগরিতে নারী শিক্ষার্থীদের অবস্থান অনেকটাই পিছিয়ে। মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ লাখ ৬৪ হাজার ২৬২ জন; মাত্র ২৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী। আর মোট শিক্ষকের সংখ্যা ৫০ হাজার ৯৩১ জন, নারী শিক্ষকের সংখ্যা ১০ হাজার ২১২ জন; মাত্র ২০ দশমিক ০৫ শতাংশ মাত্র। আর এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ২ লাখ ৮০ হাজার শিক্ষার্থী। এই শিক্ষার্থীদের আলাদা করলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হয় ১৩ লাখ ৪৭ হাজার ৭৮৫।

আবার নবম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত কারিগরির আওতায় অধ্যয়ন করে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৪ শতাংশ। কিন্তু এসব সার্টিফিকেট কোর্স আন্তর্জাতিক কারিগরি শিক্ষার আওতায় পড়ে না। আবার কারিগরি শিক্ষার অধীনে রয়েছে ২ হাজার ৬১৭টি বিজনেস ম্যানেজমেন্ট (বিএম) স্কুল ও কলেজ। এসব শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন করতে সেগুলো রয়েছে ব্যবসায় বিজ্ঞান শাখায়। এটিও কারিগরি শিক্ষার আওতায় পড়ে না।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ীও বিএম কলেজ কারিগরির অধীনে পড়ে না। কারণ তাদের অধ্যয়নের বিষয়গুলো রয়েছে সাধারণ শিক্ষা ও ব্যবসায় প্রশাসনেও। এসব কলেজে অধ্যয়নরত আছেন ৩৫ হাজার ২২৫ শিক্ষার্থী। এই বিএম কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাদ দিলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ লাখ ৩২ হাজার ২৫৯ জন। এই হিসাবে কারিগরিতে শিক্ষার হার ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ। (সংকটে কারিগরি শিক্ষা, পিয়াস সরকার, ২৩ নভেম্বর ২০১৯, দৈনিক মানবজমিন)। বৈশ্বিক বাস্তবতায়, চতুর্থ শিল্প বিল্পবের চাহিদায় এটা একেবারেই অপ্রতুল।

কারিগরি শিক্ষার মান: বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান একেবারেই খুবই পশ্চাৎপদ। সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মান কিছুটা থাকলেও সেখানে চলছে- পশ্চাৎপদ শিক্ষা দান পদ্ধতি, মান সম্পন্ন শিক্ষক, ন মান প্রশ্ন ও উত্তর পত্র মূল্যায়ন ব্যবস্থা, নকল ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন জালিয়াতি, ল্যাব ফ্যাসিলিটির স্বল্পতা, আর্থিক বরাদ্দ প্রভৃতি বহুমাত্রিক সংকট। এমনকি রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শীর্ষ নেতৃত্বের মনোযোগের সংকটও। দেশের একমাত্র সরকারি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক্সের শিক্ষকরা অধিকাংশই চুক্তিভিত্তিক। অল্প কিছু নিয়মিত শিক্ষক আছেন, যাদের মাধ্যমে ছাত্ররা খুব একটা উপকৃত হতে পারছেন না। পত্রিকান্তরে জানা যায়, এ প্রতিষ্ঠানের প্রাকটিক্যাল উপকরণের অধিকাংশই ব্যবহার অনুপযোগী, গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ছাড়াই প্রাকটিক্যাল করতে হয় শিক্ষার্থীদের। সরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য কেনা মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরি উপরকরণগুলো অনেক সময় যথোপযুক্ত ট্রেনিং ও অভিজ্ঞতার অভাবেই ব্যবহারহীন হয়ে নষ্ট হয়ে যায়।  

বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। কোথাও নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি। কারও কারও খুব ছোট একটি ল্যাব থাকলেও নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ, প্রাকটিক্যালের জন্য নেই কোনো ভারী, মূল্যবান ও অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ। রাজধানীর বাইরে বেসরকারি কারিগরি শিক্ষা চলছে নামসর্বস্ব অবস্থায়। এখানকার শিক্ষার্থীরা পলিটেকনিক্যালে পড়েন নামে মাত্র, স্বল্প কিছু মুখস্থবিদ্যা নিয়ে। এখানে নেই কোনো ভালো মানের ট্রেনিংপ্রাপ্ত শিক্ষক। নেই প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস উপকরণ। এটাকে টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কেনা বললেও খুব একটা ভুল বলা হবে না। বেসরকারি পলিটেকনিক্যাল চালুর জন্য শিক্ষক, শিক্ষা অবকাঠামোর কী কী থাকতে হবে তার স্ট্যান্ডার্ড চেক লিস্ট তৈরি ও বাস্তবায়ন হয়নি।

এসব প্রতিষ্ঠানের কারিকুলামের অবস্থাও প্রতিষ্ঠানের মতোই পিছিয়ে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে না এসব কারিকুলাম। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে কারিগরি শিক্ষার কারিকুলাম এগিয়ে নেয়ার জন্য একটি উদ্যোগের কথা বলা হয়। ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, ইন্টারনেট অব থিংস, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ব্লকচেইন টেকনোলজিসহ আধুনিক বিষয়গুলোর ওপর জোর দেয়া হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়। কিন্তু এখনও বাস্তবায়নের কোনো গতি লক্ষ্য করা যায়নি।  কারিকুলাম রয়ে গেছে সেই আগের মতোই। তবে রোবোটিক্স মেইনটেন্যান্স, কন্ট্রোল সিস্টেম মেইনটেন্যান্স সাপোর্ট, ওয়েস্ট রি-সাইক্লিং,  সোলার এনার্জি ও রিনিউয়্যাবল এনার্জির মতো বহু নতুন বিষয় শুরুর প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না।

কারিগরি শিক্ষায় পুরোনো কোর্স থাকায় চাকরির বাজারেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। যেমন ডিপ্লোমা ইন মাইনিং। কিন্তু খনিজ সম্পদ আহরণে এই প্রশিক্ষিত শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারে চাহিদা না থাকায় এই বিষয়ে পড়ে কোনো কাজে আসছে না। এসব বিষয়ে বিদেশে শ্রমবাজার খোঁজার চেষ্টাও নেই। এর মাধ্যমে বুঝা যায়, কর্মসংস্থানমুখী বিষয় চালু করতে আরও সতর্ক এবং দায়িত্বশীল হওয়া দরকার। নতুন চালু হওয়া বিষয়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শিক্ষা উপকরণ এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষক ছাড়াই দায়িত্বহীনভাবে চালু করা হয়েছে নতুন বিষয়। ‘ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট’-এর রয়েছে দেশে ও দেশের বাইরে ব্যাপক চাহিদা। মাত্র ৩ বছর আগে বিষয়টিযুক্ত হলেও রীতিমতো ধুঁকছে। বগুড়া পলিটেকনিকে দেখা গেছে, প্র্যাকটিক্যাল ছাড়াই চলছে কারিগরি শিক্ষার এই নতুন বিষয়ের কার্যক্রম। কোনো হাউসকিপিং ল্যাব,  রিসার্চ সেল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ক্লাস সামগ্রী, এমনকি একজন মাত্র প্রশিক্ষিত শিক্ষকও না নিয়েই বিষয়টি যাত্রা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একজন শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার আমাদের শিক্ষা প্রশাসকদের কাছে এতটা তুচ্ছ হতে পারে, এটা খুব লজ্জার বিষয়। 

১৩ অক্টোবর ২০১৮ দৈনিক প্রথম আলোর আয়োজনে এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সহযোগিতায় ‘পেশাগত দক্ষতার উন্নয়নে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে যশোর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল সৈয়দ আবদুল আজিজ বলেছেন, ‘পেশাগত দক্ষতার উন্নয়নে দেশে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু এসব কাজের সমন্বয় না হওয়ায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি। সুষ্ঠু সমন্বয় থাকা উচিত। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ শেষে সনদ প্রদান করা হয় না। এতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যায়। আবার দেশে সনদপ্রাপ্ত শিক্ষিত মানুষের অভাব নেই। কিন্তু পেশাগত জ্ঞানের অভাবে তাদের বেকারত্ব বরণ করতে হচ্ছে। কিছুদিন আগে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ১০ হাজার ফ্রিল্যান্সার চেয়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। প্রাথমিকভাবে ৩৩ হাজার গ্র্যাজুয়েট আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সাক্ষাৎকার ও ব্যবহারিক পরীক্ষার পর মাত্র ১৭ জন ওই পেশার জন্য নির্বাচিত হন। এটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার রুগ্ণ চিত্র। এখান থেকে বের হতে মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই।’

কারিগরি শিক্ষার প্রতিযোগিতা: বৈদেশিক প্রতিযোগিতা- সারাবিশ্ব উৎপাদনমুখী কারিগরি শিক্ষাকে ব্যাপক জোর দিয়েছে। চীন কারিগরি শিক্ষার ব্যাপারে খুবই তৎপর দেশগুলোর একটি। ২০০১ সালে চীনে ১৭ হাজার ৭৭০টি কারিগরি প্রতিষ্ঠান ছিল; যাতে অধ্যয়নরত ছিলেন ১ কোটি ১৬ লাখ ৪২ হাজার ৩০০ শিক্ষার্থী। তাদের কারিগরি শিক্ষার প্রসারের ফলে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে তাদের পণ্য। বাংলাদেশে ও বিশ্বে লেদার, প্লাস্টিক, মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিকস, অটোমোবাইল, এয়ারলাইনস, নার্সিং এসবে চাহিদা থাকলেও আসন সংখ্যার অভাবে এই খাতগুলোতে কারিগরিভাবে দক্ষ পর্যাপ্ত মানবসম্পদ তৈরি হচ্ছে না। ফলে বিশ্বে বাংলাদেশে থেকে দক্ষ শ্রমিক জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, বরং বাংলাদেশি অদক্ষ ও স্বল্প দক্ষ শ্রমিক বিদেশে গিয়েই কাজ শেখেন। কিন্তু অন্যান্য দেশ থেকে যারা শ্রমবাজারে যান তারা কাজ শিখে, সার্টিফিকেট নিয়েই দক্ষ হয়েই যান। ফলে তাদের বেতন বাংলাদেশিদের তুলনায় অনেক বেশি। অর্থাৎ এই দক্ষ শ্রম বাজারটা ধরতে যেমন আমরা ব্যর্থ হচ্ছি, তেমনি প্রতিযোগী দেশের তুলনায় একই পরিমাণ রেমিট্যান্স তৈরিতে বাংলাদেশের প্রায় দ্বিগুণের বেশি অদক্ষ শ্রমিক পাঠাতে হয়।

অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও প্রতিযোগিতা-সার্বিকভাবে কারিগরি শিক্ষায় অনাগ্রহী হওয়ার কিছু পরোক্ষ কারণও আছে। এর মধ্যে অন্যতম এসএসসি ও  এইচএসসি’র যৌথ যোগ্যতা। ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ৪ বছরের সার্টিফিকেশন কোর্স হলেও এই শিক্ষায়  কয়েকটি এন্ট্রান্স ব্যারিয়ার (প্রবেশ বাধা) আছে-

এক. সমাজে এটা হীনতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত যে, কারিগরি শিক্ষা আর্থিক ও শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে পড়াদের শিক্ষা (অর্থাৎ কারিগরি শিক্ষা প্রিভিলেইজদের শিক্ষা নয়)। কারিগরি শিক্ষা সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত নেতিবাচক ধারণা সম্পর্কে সরকার অবগত হলেও দুঃখের বিষয়, এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। দুই. মর্যাদাবান কর্ম ক্ষেত্রের অভাব; তিন. মানসম্পন্ন কাজের পরিবেশ; চার. নিন্ম বেতন; পাঁচ. ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের অতি দীর্ঘ কর্ম ঘণ্টা; ছয়. ওয়ার্ক লাইফ ব্যালান্সহীনতা; সাত. বিদেশে দক্ষ শ্রম বাজার খোঁজায় সরকার ও প্রশাসনের ব্যর্থতা; আট. সরকারি পলিটেকনিকে সীমিত আসন সংখ্যা; নয়. উচ্চশিক্ষা বা বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করার সুযোগের অভাব।

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব বেশি হওয়ায়, বিশেষভাবে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চাকরির বেশ অভাব থাকায়; ইঞ্জিনিয়ারিং চাকরির বিজ্ঞাপনের বিপরীতে মোট ডিপ্লোমা ও বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার সংখ্যায় অনেক বেশি। ফলে বহু কোম্পানি একই ওয়ার্ক-স্কিলের পদবিতে ডিপ্লোমা ও বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের যুগপৎ নিয়োগ করার বিকল্প দেয়। এতে করে বিএসসি ইঞ্জিনিয়াররা অগ্রাধিকার পেয়ে বসেন; যদিও এই ধরনের মধ্যমান কারিগরি কাজে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগের প্রয়োজন পড়ে না, শুধু ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হলেই চলে। 

এতে করে তৈরি হয়েছে আরেকটি গুরুতর সমস্যা। ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কারিগরি শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা ভয় এমন ঢুকে গেছে যে, বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং না করলে চাকরিই পাওয়া যাবে না। এই ভয়ে সাধারণত কেউ ডিপ্লোমা কোর্সে আসতে চান না।

এখানে আছে আরও দুটি বড় সমস্যা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের উচ্চশিক্ষার কন্টিনিউটি- ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাইলেই যে কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারেন না। তাদের শুধু একটি সরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (ডুয়েট) এবং কয়েকটি পর্যাপ্ত ও অপর্যাপ্ত মানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়য়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করার অতি সীমিত সুযোগ থাকে। ফলে একদিকে চাকরির স্বল্পতাজনিত মানসিক ও কর্মসংস্থান চাপ থাকে, অন্যদিকে থাকে উচ্চশিক্ষা বা বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করার সুযোগের অভাব। একদিকে ডুয়েটে আসন সংখ্যা কম, অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থাকলেও বেশিরভাগের পক্ষেই আর্থিক কারণে কারিগরি খাতের উচ্চশিক্ষার সম্ভব হয় না। সমাজে এটা হীনতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত যে, কারিগরি শিক্ষা আর্থিক ও শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে পড়াদের শিক্ষা (অর্থাৎ কারিগরি শিক্ষা প্রিভিলেইজদের শিক্ষা নয়)। অর্থাৎ আর্থিকভাবে সক্ষম পরিবার সাধারণত সন্তানদের ডিপ্লোমা কোর্সে না পাঠিয়ে বরং বেসরকারি শিক্ষায় পাঠান নিজ খরচে। ফলে বাস্তবেই দেখা যায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং করা শিক্ষার্থীদের পরিবার বেসরকারিতে উচ্চশিক্ষার অর্থাৎ বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার বহন করতে অক্ষম। ফলে তাদের চাকরিতে প্রবেশের প্রবল পারিবারিক চাপ থাকে। এতে আরেকটা সমস্যা তৈরি হয়, একদিকে চাকরি খোঁচা, চাকরি করা এবং অন্যদিকে বিএসসি করার মানসিক চাপ থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দীর্ঘ কর্ম ঘণ্টার কারণে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা সান্ধ্যকালীন কোর্সেও বিএসসি করতে সক্ষম হন না।   

ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের অতি দীর্ঘ শিক্ষাকাল-কারিগরি শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে শিল্প উৎপাদনের চাহিদা মাফিক দ্রুত, দক্ষ ও কারিগরি মানবসম্পদ তৈরি করা। কিন্তু বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার সামাজিক সম্মান না থাকায় কারিগরি শিক্ষার মান নিচু হওয়ায় এবং বাজারে প্রচুর কর্মসংস্থান চাহিদা না থাকায়, কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতদের আরও উচ্চশিক্ষা নিতে হয়। এতে শিক্ষাকাল দীর্ঘ হয়। ক্যারিয়ারে বেশ কিছু বছর অযথা নষ্ট হয়।

কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে ব্যস্থাপনাগত সুপারিশ: প্রথম আলোর আয়োজনে এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সহযোগিতায় ‘পেশাগত দক্ষতার উন্নয়নে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সরকারি–-বেসরকারি অংশীদারত্ব’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠক ১৩ অক্টোবর ২০১৮ অনুষ্ঠিত হয়। এতে যে সুপারিশগুলো আসে তার সংক্ষিপ্ত হচ্ছে-

১. সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব মডেল পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারি বাজেট সুনির্দিষ্ট হওয়া উচিত। ২. কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনবল সৃষ্টিতে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। ৩. শ্রমিকদের পর্যাপ্ত মজুরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে কাজের ক্ষেত্রে আগ্রহী করে তুলতে হবে। ৪. কারিগরি শিক্ষায় শিল্পকারখানার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ শিক্ষানীতি প্রয়োজন। ৫. শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ বজায় রাখতে হবে। ৬. সরকারি- বেসরকারি অংশীদারিত্ব মডেলের আওতায় প্রশিক্ষণ প্রদানের পর সনদ প্রদান করা উচিত।

কারিগরি শিক্ষার সমস্যা সম্ভাবনা ও সুপারিশের সংক্ষিপ্তসার-

১. কারিগরি শিক্ষার গুণগতমান উন্নত করা ও সর্বেসর্বা দক্ষতা নিশ্চিত করা এখনও হয়নি। কারিগরি শিক্ষা অবহেলিত গরিবের শিক্ষা। ২. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার কোর্স সমূহকে  আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারগুলোর  স্বীকৃতি লাভের চেষ্টা করা। ৩. শিল্প-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্ক উন্নয়ন করা। শিক্ষার সঙ্গে দেশীয় শিল্প উৎপাদন ও কারিগরি ব্যবস্থাপনা সমস্যাগুলোর সমাধানকেন্দ্রিক সংযোগ তৈরি করা। দক্ষ জনবল তৈরিতে, ইন্ডাস্ট্রি সমস্যার সমাধান তৈরি করতে কোম্পানিগুলোর শিক্ষা বিনিয়োগের টেকসই প্রক্রিয়া ও দুর্নীতিমুক্ত কাঠামো তৈরি করা। ৪. পর্যাপ্ত অবকাঠামো, ল্যাবরেটরি সুবিধা, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষক ও শিক্ষক ট্রেনিং প্রস্তুতি নিয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন নতুন নতুন কারিগরি শিক্ষা কোর্স চালু করা। সেগুলোতে মান ও দক্ষতা নিশ্চিত করা। ৫. বিদেশি শ্রমবাজারের চাহিদার পাশাপাশি বাংলাদেশি শিল্প-কারখানা চাহিদা অনুযায়ী দরকারি কোর্স কারিকুলাম প্রণয়ন। ৬. ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানসমূহের অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং ল্যাব সুবিধার অভাবে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা প্রদান সম্ভব হচ্ছে না। এর স্থায়ী উত্তরণ। ৭. গ্রামের দরিদ্র ছেলেরা সাধারণত কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের জন্য আসে। আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য ড্রপ আউটের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি। ড্রপ আউটের হার কমানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে বোধগম্য হারে শিক্ষা উপবৃত্তি দেয়া যায় কিনা সেটা বিবেচনা করা। ৮. সব সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণ, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে মান আনা। নকল, শিক্ষাহীনতা ও দুর্নীতির বিপরীতে সঠিক অবকাঠামো ও জনবল তৈরি। ৯. বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দক্ষাতার আলোকে সাজানো। ১০. বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা কর্তৃক বিভিন্ন ধরনের এবং মেয়াদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করা হয়। এগুলো যাতে সার্টিফিকেট সর্বস্ব না হয়ে কর্মবাজারের চাহিদামাফিক হয় তার তদারকি ব্যবস্থা চালু করা। সব প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব কাটিয়ে ওঠা। ১১। শিক্ষা বাজেটে কারিগরি শিক্ষার চাহিদার তুলনায় বাজেট অপর্যাপ্ত। প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত করা। কারিগরি শিক্ষায় কেন্দ্রীয় মনোযোগ বাড়ানো। বিভিন্ন প্রণোদনা বাড়ানো। বরাদ্দ সঠিকভাবে ব্যয়িত হচ্ছে কিনা তার সঠিক তদারকির প্রক্রিয়া তৈরি করা। ১২. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিষয়ে জনসচেতনতা এবং এ বিষয়ে ইতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব।

টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক।

‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ:  অর্থনীতির ৫০ বছর’ এবং ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা’ বইয়ের লেখক

faiz.taiyeb@gmail.com